পাকা চার দেওয়ালের মধ্যে নয়, খোলা রাস্তাতেই রোজ বসে তাঁর স্কুল। পায়ের তলার মাটি ও খোলা আকাশের নীচেই খুদে শিক্ষার্থীর পড়া মুখস্থ করার আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। প্রথাগত শিক্ষা শুধু নয় আদিবাসী সমাজের শিশুদের জীবনের পাঠ দিচ্ছেন রোজ। তিনি দীপনারায়ণ নায়েক (Deep Narayan Nayak)। স্থানীয় ছেলেপুলে আর তাদের বাবামায়েদের কাছে যিনি পরিচিত ‘রাস্তার মাস্টার’ (Teacher of Street) নামে।রাস্তাতেই তাঁর স্কুল, তাই তিনি রাস্তার মাস্টারমশাই (Teacher of Street)। জামুড়িয়ার আদিবাসী অধ্যুষিত তিলকামাঝি গ্রামের আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে রোজ বসে তাঁর রাস্তার স্কুল। নামতা মুখস্থ করানোর পাশাপাশি কোভিড বিধিও শেখান ছাত্রছাত্রীদের। মুখে মাস্ক, হাতে স্যানিটাইজার দিয়ে দূরত্ব রেখে বসে তবেই শুরু হয় লেখাপড়া। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও সেখানে নিয়ম।
বাড়ির নিকোনো দেওয়ালে রঙ করিয়ে সেখানেই তৈরি হয়েছে ব্ল্যাকবোর্ড। রাস্তায় আসন পেতে বসেই অক্ষর চিনছে পড়ুয়ারা। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা বর্ণমালা। বাড়ির বাইরে পা রাখলে শুধু খেলাধূলা নয়, পড়াশোনাও আকর্ষণ করছে তাদের। গোটা গ্রামই যেন এক পাঠশালা। বই-খাতা, পেন-পেন্সিল পর্যাপ্ত না থাকলেও চলছে পড়াশোনা। বড় স্কুলে পড়াশোনা করার সামর্থ নেই যে শিশুদের, তাদের জন্য স্কুলকে পথেই নিয়ে এসেছেন মাস্টারমশাই। লকডাউনের আগে থেকেই দুঃস্থ শিশুদের বিনামূল্যে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। লকডাউন শুরু হওয়ার পরে তাঁর দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। মাস্টার দীপনারায়ণ বলেছেন, গোড়ায় একজন, দু’জন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু হয়েছিল পথচলা। এরপর ধীরে ধীরে ৭ জন, ১১ জন করে বাড়তে বাড়তে এখন স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা শতাধিক। নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসছে। তাদের পড়াশোনা করতে খুবই উৎসাহী।
মাস্টারমশাই বলছেন, আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখাতে গিয়ে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা হল এরা সকলেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। পরিবারের সকলেই নিরক্ষর। তাই শিশুদের পাশাপাশি তাদের বাবা-মা, পরিবারের অন্যদেরও লেখাপড়া শেখানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দীপনারায়ণ। “একদিকে বাবা-মা-ঠাকুমা-দাদুরা পড়ছেন, অন্যদিকে তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা পড়া মুখস্থ করছে। শিশু শিক্ষার্থী নাকি তাদের বাবা-মায়েরা, কে আগে লিখতে-পড়তে শিখবে সে নিয়ে প্রতিযোগিতাও চলে,” বললেন মাস্টারমশাই। কখনও ইংরাজি, কখনও নামতার ক্লাস আবার কখনও পিটি ক্লাস, রাস্তার স্কুলে সবই শেখে শিশুরা। লিখতে-পড়তে শেখে তাদের বাবা-মায়েরাও। মাস্টারমশাই দীপনারায়ণ বললেন, এই তিলকামাঝি গ্রামের বেশিরভাগ আদিবাসী মায়েরাই এখন নিজের নাম লিখতে পারেন। তাঁরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেন। নিয়মিত স্কুলে আসেন।
মাস্টারমশাই দীপনারায়ণের কৃতিত্বের এখানেই শেষ নয়। তিনি গ্রামে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালু করেছেন। নানা রকম বই নিয়ে গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটছে মোবাইল লাইব্রেরি। কখনও তিনি কখনও পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা উদ্যোগ নিয়ে বই বিলি করছেন পাড়ায় পাড়ায়। শিক্ষাকে শুধু সিলেবাসে বন্দি করছেন না দীপনারায়ণ, আদিবাসী সমাজে প্রকৃত জীবনের পাঠ পড়াচ্ছেন তিনি নিঃস্বার্থভাবে। এখানে কোনও সামাজিক বার্তা নেই, কোনও সংস্কারের ঘেরাটোপ নেই। শুধু অনাবিল আনন্দ আছে। শিশু ও তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোই তাঁর লক্ষ্য, আর এখানেই মাস্টারমশাই দীপনারায়ণের জয়।করোনার সময়েও আদিবাসী সমাজের হাত ধরেছিলেন মাস্টার দীপনারায়ণ।
বললেন, “কোভিড ভ্যাকসিন তখন এসেছে। এদিকে ভ্যাকসিন নিয়ে আদিবাসী সমাজে ভুল ধারণা আছে। কেউ সূঁচ ফোটাতে রাজি নয়। সেই সময় ঘরে ঘরে গিয়ে সকলকে বোঝাই। টিকা নিতে রাজি করাই। এখন কয়েকশো পড়ুয়ার মা ভয় কাটিয়ে টিকা নিয়েছেন। সুস্থ আছেন সকলে।”শিক্ষার আলো দিয়ে কুসংস্কারের অন্ধকার কাটাচ্ছেন ‘অপরাজেয়’ মাস্টারমশাই। আদিবাসী সমাজে এতদিন ভূত-প্রেত, তন্ত্র-মন্ত্রের অন্ধবিশ্বাস ছিল। সেই আঁধার শিক্ষার আলো দিয়ে ধুয়েমুছে দিচ্ছেন দীপনারায়ণ। কুসংস্কার কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল আদিবাসী সমাজে সে নিয়ে একটা ছোট ঘটনাও বললেন মাস্টারমশাই। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল এক পড়ুয়া। সকলে ভেবেছিল তাকে ভূতে ধরেছে। ঝারফুঁক, ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়ার আগেই দীপনারায়ণ তাঁকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। বাচ্চাটার তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা করে ধরা পড়ে ম্যালেরিয়া। চিকিৎসায় সুস্থ হয় সে। এখন দীপনারায়ণের স্কুলেই লেখাপড়া করছেন, কুসংস্কারে আর বিশ্বাস নেই।
স্কুলছুটের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা আর অপুষ্টি দূর করাই লক্ষ্য মাস্টারমশাইয়ের। শিক্ষার সঙ্গে শিশু ও তাদের বাবা-মায়েদের সুস্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল রাখছেন তিনি। আদিবাসী সমাজকে মূলসমাজের স্রোতে মিলিয়ে দেওয়ার কঠিন লড়াই লড়ছেন দীপনারায়ণ। জামুড়িয়ার আদিবাসী সমাজে এখন স্কুল আক্ষরিক অর্থেই তাদের দুয়ারে পৌঁছে গেছে। মাস্টারমশাই বলছেন, তিনি যখন থাকবেন না তখনও ছেলেমেয়েরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। লেখাপড়া এখন আতঙ্ক নয়, আদিবাসী শিশুদের মজ্জায় গেঁথে গেছে। আর এখানেই একজন শিক্ষকের জয়। জয়ী হয়েছেন রাস্তার মাস্টারমশাই দীপনারায়ণ নায়ক।