জীবনের মূল্য মানুষ কখন সবচেয়ে ভালো বোঝে? বেঁচে থাকার তাড়নায় যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কিংবা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকে। তবে রায়ান ক্যাম্পবেলের এই উপলব্ধি হয়েছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে!এপ্রিলে পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডস দলের প্রধান কোচ ক্যাম্পবেল। ১৬ এপ্রিল স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে পার্কে ঘুরছিলেন। হঠাৎ সেখানেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন ৫০ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে সিপিআর (হৃদ্–ফুসফুস পুনরুজ্জীবিত করা) দিয়ে নেওয়া হয় হার্টশিলের রয়্যাল স্টোক ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে। ক্যাম্পবেল চলে যান কোমায়।
পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানান, ক্যাম্পবেলের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা মাত্র ৭ শতাংশ! এ কথা শোনার পর পরিবারের মাথায় যেন বাজ পড়ে। একটা সুখী পরিবারে নিমেষেই নেমে আসে বিষাদের ছাপ।এর পর থেকে যা কিছু হয়েছে, সেটাকে ‘অলৌকিক’ বললেও কম হয়ে যায়। যাঁকে নিয়ে খোদ চিকিৎসকেরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেই ক্যাম্পবেল চার দিনের মাথায় কোমা থেকে বেরিয়ে আসেন! মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ না হওয়ায় তাঁকে ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধে পরিবার। তবে বুকে ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট থাকায় আরও সপ্তাহ দুয়েক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকতে হয়।ক্রিকেট পাগল ক্যাম্পবেল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই কাজে যোগ দেন। শিষ্যদের পক্ষ থেকে পান রাজসিক প্রত্যাবর্তনসম সংবর্ধনা। ২০১৭ সালে ডাচদের দায়িত্ব পাওয়া ক্যাম্পবেল বলার মতো সাফল্য এনে দিতে না পারলেও ‘দ্বিতীয় জীবন’টাকে বোধ হয় প্রমাণের শেষ সুযোগ হিসেবে নিয়েছিলেন।
তাঁর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে ১৬ অক্টোবর। ওই দিন বিশ্বের নানা প্রান্তের শুভানুধ্যায়ীদের বার্তা পেয়েছেন। সেটার রেশ থাকতেই এবার মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের খেতাব পেয়ে যেতে পারেন।আট বছর পর নেদারল্যান্ডস কোনো বৈশ্বিক আসরের দ্বিতীয় পর্বে উঠেছে ক্যাম্পবেলের কোচিংয়ে। জিলংয়ে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে নিজেদের শেষ ম্যাচে আজ শ্রীলঙ্কার কাছে হারলেও গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে সুপার টুয়েলভ পর্বে জায়গা করে নিয়েছে তাঁর দল। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আসরে শেষবার এত বড় সাফল্য পেয়েছিল ডাচরা। সেই বাংলাদেশকে দিয়েই সোমবার সুপার টুয়েলভ অভিযান শুরু হচ্ছে তাদের। ছয় মাস আগে যে মানুষটার সঙ্গে ক্রিকেটের পুনঃ সংযোগ ঘটনো দূরের কথা, জীবন প্রদীপটাই নিবু নিবু করছিল, সেই তিনি কোচিংয়ে ফিরে দলকে নিয়ে গেলেন বিশ্বকাপ শিরোপা লড়াইয়ের মঞ্চে! ক্যাম্পবেল মৃত্যুঞ্জয়ী বীর নন তো কী?
এই সাফল্য ধরা দেওয়ার আগেই ক্যাম্পবেল অবশ্য দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের সঙ্গে আলোচনায় মনের বাক্স খুলে দিয়েছেন ডাচ কোচ। বলেছেন, ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর আক্ষরিক অর্থেই লুটিয়ে পড়েছিলাম। আমার স্ত্রী বলেছে, পরের দুই–তিন দিনে আমি ১৫ বার মারা গিয়েছি। তবে বেশ কিছু কারণে আমি বেঁচে ফিরেছি। পরিবার ও বাচ্চাদের ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। আবেগ বলছে, হাল ছাড়ার পাত্র আমি নই। এখনো বেঁচে আছি ভেবে আনন্দিত।’ক্যাম্পবেল ‘যমদূতের’ দুয়ার থেকে ফেরার আগের মাসেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন শেন ওয়ার্ন ও রডনি মার্শ। একই দিনে দুই কিংবদন্তির চলে যাওয়া তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে, ‘আমরা সবে রড মার্শকে হারিয়েছি। তিনি আমার ক্রিকেট একাডেমির কোচ ছিলেন। আমি তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এবং শেন ওয়ার্নের কথা না বললেই নয়। তিনিও চলে গেলেন। এরপর আমি শুধু দুঃখের বহিঃপ্রকাশ দেখেছি। আমার (হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর) প্রতিও সব সংবাদমাধ্যম একই রকম আন্তরিকতা দেখিয়েছে। অথচ বিশ্ব ক্রিকেটে আমি রড মার্শ–শেন ওয়ার্নের ধারেকাছেও নেই। তখন ভাবলাম, আমি তো তাঁদেরই মতো আরেকজন ৫০ পেরোনো ক্রিকেটার, যার হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা আছে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, বিশ্বজুড়ে আসলে কী চলছে?’দ্বিতীয় জীবনে পা রাখা ক্যাম্পবেল কোচের পাশাপাশি এখন স্বাস্থ্যকর্মীও। বিশ্বের বৃহত্তম সিপিআর ক্লাস ‘হার্ট অব দ্য নেশন’–এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন তিনি।মানবস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলাই তাঁর কাজ। ১৬ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পালিত হয়েছে ‘একটি হৃদয়ের পুনর্জাগরণ’ দিবস। সেখানে আমন্ত্রণ পেয়ে ছুটে যান ক্যাম্পবেলও। ডাচ কোচ যে এখন জীবনের মর্মার্থটা বোঝেন আরও ভালোভাবে! সে প্রসঙ্গ টেনেই বলেছেন, ‘আমরা কেউই অমর নই। তবে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। জীবন আমাকে এই একটি জিনিস খুব ভালোভাবে শিখিয়ে দিয়েছে। তাই সবার প্রতি অনুরোধ, পারিবারিক চিকিৎসককে ডেকে নিন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।’মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে জিতে আসা ক্যাম্পবেলের খ্যাতি বিশ্বজোড়া হবে কি না, সময়ই বলে দেবে। তবে তাঁর নামের পাশে ‘বৈশ্বিক নাগরিক’ তকমাটা অনেক আগেই জুটে গেছে। জন্মেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। স্ত্রী নেদারল্যান্ডসের। সন্তানেরাও ডাচ ভাষায় অনর্গল। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দুটি ওয়ানডে খেলা ক্যাম্পবেল পরে হংকংকেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন।সৃষ্টিকর্তা ক্যাম্পবেলকে ‘জীবনদান’ করেছেন। তবে কারও না কারও হাত দিয়ে। সেই মানুষটার নাম বেকি বাসেট। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে পার্কে লুটিয়ে পড়ার পর এই বাসেটই ক্যাম্পবেলকে তৎক্ষণাৎ সিপিআর দিয়ে হাসপাতালে পাঠান। চিরকাল ‘ঋণী’ হয়ে থাকা বাসেটের অবদান একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন ডাচ কোচ, ‘আমি আজ বেঁচে আছি বেকি বাসেট নামের মেয়েটার জন্য। সে সবে সিপিআর নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছিল। সে–ই আমাকে সিপিআর দিয়ে টেনে তুলেছে।’
কীভাবে? তাঁর দাদি যে চীনের! সময়–সুযোগ পেলে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসেও যাওয়া–আসা করেন। সেখানে আছেন বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।ও হ্যাঁ, নিজেকে মার্শ–ওয়ার্নের কাতারে নিয়ে যেতে না পারলেও ক্যাম্পবেলের নাম জড়িয়েছে বিচিত্র এক বিশ্ব রেকর্ডে। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছেন, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সে অভিষেক হয়েছে তাঁর—৪৪ বছর ৩০ দিন। ভারতে অনুষ্ঠিত ২০১৬ আসরে এ কীর্তি গড়েন তিনি।এবার জন্মভূমিতে চলমান আরেকটি বিশ্ব আসর দিয়ে নেদারল্যান্ডসের দায়িত্ব ছাড়ছেন ক্যাম্পবেল। সুপার টুয়েলভে দল যেমনই করুক, তাঁর হারানোর কিছু নেই। তিনি যে ‘যমদূত’কে হারিয়ে এসেছেন! উপভোগের মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে চলা ক্যাম্পবেল ক্রিকেটের সঙ্গে আরেকটি জিনিস উপভোগ করছেন—জীবন!