২০১০ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন রবীন্দ্র ঘোষ। সবাই তাঁকে জুয়েল নামেই চেনেন। নাম জুয়েল হলেও সমাজের প্রচলিত রত্নের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না জুয়েলের। কিন্তু তার একটা আগ্রহ ছিল ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল নিয়ে ব্যবসা করতে করতে তার মাথায় এমন আইডিয়া আসে আজকে সে একটা কোটি টাকার বিজনেস তৈরি করেছে।।
টানা ১০ বছরের চড়াই–উতরাইয়ে জুয়েল তৈরি করেছেন প্লাস্টিকের চূর্ণের (পেট ফ্লেক্স) প্রতিষ্ঠান মুনলাইট পেট ফ্লেক্স। সব মিলিয়ে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক থেকে বের করে এনেছেন এমন ব্যবসা, যা থেকে বছরে আয় করা সম্ভব প্রায় ৪০ কোটি টাকা। দেশি তো বটেই তাঁর কারখানায় দুজন চীনা কর্মীও কর্মরত আছেন। লেখাপড়া শেষে সবাই যখন ব্যাংকের চাকরি, বিসিএসের পেছনে ছোটে, জুয়েলের স্বপ্নই ছিল ব্যবসায়ী হবেন। তিনি জানতে পারেন ভাঙারির দোকানে থাকা প্লাস্টিকের বোতল গুঁড়া করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পরিচয় হয় এ কাজের একজন মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে। বাবার কাছ থেকে জমানো কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়লেন এ ব্যবসায়। সঙ্গে ছিল হাতে তৈরি দেশীয় কিছু যন্ত্র আর মাত্র তিনজন কর্মী।
‘ভাঙারিদের সঙ্গে ব্যবসা করতে হলে একদম তাঁদের সামনে যেতে হয়,’—বলেন জুয়েল। ‘আমি সে সময় শহরজুড়ে ভাঙারিদের খুঁজে বের করতাম, সেগুলা ভাঙানোর কাজ করতাম, রপ্তানির জন্য কাগজপত্র গোছানোর কাজ করতাম। সব মিলিয়ে দিনের ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কখন চলে যেত বুঝতেও পারতাম না।’কাজ করতে করতে কাজে হাত পাকতে থাকল রবীন্দ্রর। ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশের পেট ফ্লেক্স রপ্তানিকারকদের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘এই ব্যবসাটা খুব সনাতনীভাবে হতো, শিক্ষিত বিক্রেতা ছিলেন না বললেই চলে। কিছু মধ্যস্থতাকারী ছিলেন, তাঁরা নানাভাবে ঠকাতেন। আমি নিজে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, চাহিদামাফিক পণ্য এনে দিতাম। এভাবে খুব দ্রুত আমি ওপরের দিকে উঠে যাই।’
চীনা সেই বন্ধুর পরামর্শে দেশে আনা হয় নতুন মেশিন, সঙ্গে দুজন চীনা টেকনিশিয়ান। তাঁদের কাজ ছিল আন্তর্জাতিক মানের স্ট্রাপ তৈরি করা। আরামবাগেই নেওয়া হয় নতুন কারখানা। সে কারখানাতেই কথা হয় রবীন্দ্র ঘোষের সঙ্গে।প্রায় দুই কাঠার ওপরে মুনলাইট ফ্লেক্স অ্যান্ড স্ট্রাপ ইন্ডাস্ট্রি। তিনটা লাইনে তৈরি হচ্ছে স্ট্রাপ। কারখানার এক পাশে মিহিদানা করা হচ্ছে প্রাথমিকভাবে চূর্ণ করা প্লাস্টিক। সেই চূর্ণই আসছে মেশিনে গলে আবার নতুন করে স্ট্রাপ হতে। ঢাকার মেরাদিয়ার আরেকটা আলাদা কারখানায় প্রাথমিকভাবে তৈরি করা হয় ফ্লেক্স। বড় মাঠের মতো জায়গায় জমিয়ে রাখা হয় কুড়িয়ে আনা বোতল। সেই বোতল ভাঙা হয় সেখানে।
- ‘আমি বিশ্বাস করি, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সম্ভাবনা থাকে। আমাদের সম্ভাবনা হচ্ছে আমাদের কাছে কাঁচামালের সরবরাহ আছে। এই করোনায় অনেকেই ঝরে পড়বেন, যাঁরা টিকে যাবেন তাঁরা সামনে বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করবেন। আমি সেই আশাতেই কাজ করে যাচ্ছি।’
স্ট্রাপের বাজার ধরলেও পুরোনো ফ্লেক্সের ব্যবসা থেকে সরে আসেননি রবীন্দ্র ঘোষ। ‘চীনের কাছে ফ্লেক্স দেওয়া বন্ধ হওয়ার পরে আমি অন্যান্য দেশে চেষ্টা করতে থাকি। এরপর দেখা যায় বাংলাদেশের ফ্লেক্স লাগছে, ভিয়েতনাম থেকেও অর্ডার আসছে। এখন বাংলাদেশেও ফ্লেক্স রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পর ভিয়েতনাম আমাদের বড় বাজার। আর আমাদের নিজেদের চাহিদা তো আছেই।’ ২০২০ সব ব্যবসার জন্য খুব কঠিন বছর গেছে, মুনলাইটও তার ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্র ঘোষ জানালেন, পণ্য রপ্তানির ফরমাশ কমে এসেছে অর্ধেকে আর দামও পড়ে গেছে অনেক। এর বাইরে করোনার মধ্যে কাঁচামাল সংগ্রহ কারখানা চালু রাখার সীমাবদ্ধতা তো ছিলই। তারপরও মন শক্ত করে ব্যবসায় টিকে আছেন তিনি।