বাবার শেষকৃত্য করেন ধার করে,ধান বয়ে মিলত সামান্য খাবার,যা করে দেখালেন যুবক,গর্বিত বাংলা!

তাঁর জীবনকাহিনি সিনেমার চিত্রনাট্যকে হার মানাতে পারে। মনে হতে পারে, বাস্তব নয়, এ যেন রূপকথার গল্প! অচিন্ত্য শিউলি (Achintya Sheuli)। হাওড়ার দেউলপুরের অ্যাথলিট কমনওয়েলথ গেমসে (Commonwealth Games 2022) ইতিহাস গড়েছেন। ভারোত্তোলনে ৭৩ কেজি বিভাগে জিতেছেন সোনা। স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে ৩১৩ কেজি ওজন তুলে গড়েছেন রেকর্ড।

অচিন্ত্যর সাফল্যের দিন তাঁর দাদা, কোচ ও বন্ধুদের মনে পড়ে যাচ্ছে সংগ্রামের সেই দিনগুলির কথা। যখন বাবার শেষকৃত্য সারতে লোকের কাছে হাত পাততে হয়েছিল অচিন্ত্যকে। সুষম খাবার ছিল অলীক কল্পনা। সামান্য খাবার জোগাড়ের জন্য ধান বইতে হয়েছে, করতে হয়েছে জরির কাজও।বার্মিংহামে অচিন্ত্যর সোনা জয়ের পর উৎসবের আবহ হাওড়ার দেউলপুর গ্রামে। রবিবার রাত জেগে গ্রামের সকলে মিলে একসঙ্গে খেলা দেখেছেন।

```

সোনাজয়ী ভারোত্তোলকের দাদা অলোক (Alok Sheuli) এবিপি লাইভকে বলছিলেন, ‘ভাইয়ের এই সাফল্য আমাদের কাছে খুবই আনন্দের মুহূর্ত। পরিশ্রমের ফল পেয়েছে। কম লড়াই তো ওকে করতে হয়নি।’ বাবা ভ্যান চালাতেন। অলোক বলছিলেন, ‘মাত্র ৩৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় বাবা। ২০১৩ সালে। সে এক অন্ধকার সময়। অচিন্ত্যর বয়স তখন সবে ১১। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, বাবাকে দাহ করার উপায় ছিল না। ধার করে বাবার শেষকৃত্য করতে হয়েছিল। আমি ভারোত্তোলন প্র্যাক্টিস করতাম। অচিন্ত্যও আমার হাত ধরে অষ্টম স্যারের কাছে ভারোত্তোলন শুরু করেছিল। ঠিক সেই সময়ই বাবার মৃত্যু।’

কিংবদন্তি সচিন তেন্ডুলকরের (Sachin Tendulkar) উত্থানের নেপথ্যে যেমন দাদা অজিত ও গুরু রমাকান্ত আচরেকর, অচিন্ত্য তেমনই পেয়েছেন অলোক ও কোচ অষ্টম দাসকে। অলোক বলছেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর সংসার চালাতে দুই ভাই মায়ের সঙ্গে জরি বসানোর কাজ করেছি। ভারোত্তোলকদের পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার লাগে। আমরা তা পেতাম না। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। দিনের শেষে এক প্লেট ঘুগনি আর একটা ডিমসিদ্ধ পাবে বলে ধান বওয়ার কাজ করেছে অচিন্ত্য। জাতীয় শিবিরে গিয়ে একবার সাতশো টাকা পেয়েছিল। সেটাই তখন বিরাট ব্যাপার ছিল আমাদের কাছে।’

```

অলোকের আক্ষেপ, প্রশাসনিক স্তরে কোনও সমর্থন পাননি তাঁরা। বলছেন, ‘২০২০ সালে সরকারের তরফে পুরস্কার পেয়েছিল। তারপর আর কেউ খোঁজ নেয়নি।’ রবিবারের পর থেকে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে দেশ ও রাজ্যের হেভিওয়েট রাজনীতিকরা ট্যুইট করে অভিনন্দন জানিয়ে চলেছেন।

অচিন্ত্যর দিনবদলের শুরু সেনাবাহিনীর শিবিরে সুযোগ পেয়ে। যে কাহিনি শোনালেন কোচ অষ্টম দাস (Astam Das)। বললেন, ‘অচিন্ত্য সোনা জিতবে জানতাম। ভীষণ পরিশ্রমী। বছর দশেক বয়সে আমার কাছে আসে। ওর দাদা অলোক ভারোত্তোলন প্র্যাক্টিস করত। তবে অচিন্ত্য ভারোত্তোলন শুরু করার পরই ধাক্কা। ওর বাবা মারা গেল। আমি কারও কাছেই পারিশ্রমিক নিই না। ভালবেসে ভারোত্তোলনে প্রশিক্ষণ দিই। নিখরচায় ট্রেনিং করাই। ভারোত্তোলকদের পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার খুব জরুরি। অচিন্ত্য তা পেত না। খুব গরিব বাড়ির ছেলে। টালির চালের ঘরে থাকত। বাবা মারা যাওয়ার পর অচিন্ত্য, ওর মা ও দাদা মিলে জরির কাজ করত। সকালে স্কুল, বিকেলে প্র্যাক্টিস, সন্ধ্যায় জরির কাজ। যা রোজগার করত, ডিম কিনে খেত। আড়াই-তিন ঘণ্টা প্র্যাক্টিস করত রোজ।’

ইয়ুথ ন্যাশনালে ৫০ কেজি বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন অচিন্ত্য। তারপরই ছ’জন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে পুণে যান অষ্টম। সেখানে সেনাবাহিনীর ট্রায়াল চলছিল। নির্বাচিত হন অচিন্ত্য। ২০১৪-১৫ মরসুমে। তারপরই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে হাওড়ার অ্যাথলিটের।২০ বছর বয়সী ভারোত্তোলকের বন্ধু তথা সতীর্থ বাদল বর বলছিলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর ভীষণ কঠিন সময় কেটেছে ওর। ২০১৩ সালে জাতীয় স্তরে পদক পায়। পুণে-তে সেনাবাহিনীর স্পোর্টস ইনস্টিটিউটে সুযোগ পাওয়ার পর অবশ্য প্রস্তুতির পর্যাপ্ত পরিসর পেয়েছিল। আর্মি স্কুলে পড়াশোনার সুযোগও পেয়েছিল।’

অষ্টম বাড়িতেই চালান ভারোত্তোলনের কোচিং ক্যাম্প। তাঁর হাত ধরে অনেক ছেলে-মেয়ে জাতীয় স্তরে পদক জিতেছেন। কিন্তু অষ্টমের না আছে চাকরি, না পরিকাঠামো। সোনাজয়ী অ্যাথলিটের কোচ বলছিলেন, ‘কখনও চাষবাসের কাজ করি, কখনও কারখানায় কাজ। রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে হিসাবে কাজ করেছি লকডাউনের সময়। মাটি কাটার কাজও করি।’ তাঁর আক্ষেপ, ‘প্রচুর ছেলেকে তৈরি করেছি। পরিকাঠামো নেই। গাছের ছায়ায় প্র্যাক্টিস করাই। বৃষ্টি হলে প্র্যাক্টিস বন্ধ। বাড়িতে একটা ছোট শেড রয়েছে। সেখানে সরঞ্জামগুলো রাখতে পারি শুধু। আয়রন বার বা ওজনে মরচে পড়ে গিয়েছে। তাতে প্র্যাক্টিস করতে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের কেটে-ছড়ে যায়। উন্নত পরিকাঠামো পেলে অনেক ভাল কাজ করা যায়।’অচিন্ত্যর সোনা জয়ে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছে ভারোত্তোলনে তাঁর আঁতুরঘরও।