স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একজন বাঙালি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ, জীববিজ্ঞানী এবং প্রথম কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা। তিনি ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়ীখাল গ্রামে তার পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল। তার বাবা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এর আগে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।জগদীশ চন্দ্র বসু ভারতে প্রথম এক্স-রে মেশিন নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন।
রেডিওর আবিষ্কারকও তিনি। তিনিই প্রথম বলেছিলেন উদ্ভিদের প্রাণ আছে। সবার আগে বারবার বিজ্ঞানের বড় আবিষ্কার এবং তত্ত্বগুলো আনেন বিশ্ববাসীর সামনে। তবে বাঙালি বলেই যোগ্য সম্মান পাননি তিনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার বাঙালি এই বিজ্ঞানী বারবার তার দুঃখের কথা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন লেখায়।প্রথমে আসি এক্স-রের কথায়। ১৮৯৫ সালে এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি আবিষ্কার করা হয়। ভারত উপমহাদেশে তা এসে পৌঁছতে আরও সময় লেগেছিল। কিন্তু তার আগেই স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ভারতের প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরিতে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। তার এক চিঠির মাধ্যমে এ তথ্য জানা যায়।১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘যদি পারেন তাহা হইলে সকাল আটটার সময়ে প্রেসিডেন্সী কলেজ হইয়া আসিবেন। রঞ্জন কলে একজন রোগী দেখিতে হইবে, তাহার পৃষ্ঠভঙ্গ হইয়াছে। ডাক্তার নীলরতন সরকারের কথা এড়াইতে পারিলাম না।’
তখন কেউ জানতই না প্রেসিডেন্সির ল্যাবরেটরিতে বসে বসু কী কাণ্ডই না ঘটাচ্ছিলেন।এবার তাহলে রেডিওর কথা বলা যাক। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছাড়া একে আর কী-ই বা বলা যেতে পারে। ছোটবেলায় বিজ্ঞান বইতে দেখেছি- রেডিও আবিষ্কারক মার্কনি। কিন্তু এই যন্ত্রের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু।আসলে চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন তিনি। বসু নিজের সৃষ্ট অণুতরঙ্গ ভিত্তিক বেতার সংকেত প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন মার্কারি কোহেরার। যন্ত্রটি কলকাতা বসেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন।যন্ত্রটিতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন তার নাম সলিড স্টেট ডায়োড। ১৮৯৯ সালের বিভিন্ন সময়ে এই কোহেরার যন্ত্রটি প্রদর্শিত হয়েছিল। বসু উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি ১৮৯৯-১৯০১ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোথাও ছিল না। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, সলিড স্টেট ডায়োড ডিটেক্টর এবং মাইক্রোওয়েভ প্রজাত অদৃশ্য আলোর জনক তিনি।
১৯০১ সালে মার্কনি যে ডায়োড ডিটেক্টর যন্ত্র দিয়ে আটলান্টিকের এপার থেকে ওপারে বেতার সংকেত পাঠিয়েছিলেন, তা ১৮৯৭ সালে লন্ডন রয়্যাল সোসাইটিতে প্রদর্শিত জগদীশচন্দ্রের নির্মিত যন্ত্রের হুবহু নকল। কিন্তু কিভাবে চক্রান্তটি হয়েছিল? আসলে মার্কনির ছেলেবেলার বন্ধু লুইগি সোলারি তখন ইতালির নৌবাহিনীতে কাজ করছিলেন। তিনিই এই মার্কারি কোহেরার যন্ত্র ও টেলিফোন গ্রাহক যন্ত্রের নির্মাণ ও ব্যবহার পদ্ধতি মার্কনির সামনে আনেন।শুধু তাই নয়, তিনিই প্রকৃতপক্ষে জগদীশ চন্দ্রের সমগ্র প্রযুক্তির হুবহু নকল করে একটি যন্ত্র নির্মাণ করে ইংল্যান্ডে গিয়ে মার্কনিকে উপহার দেন। সেটাকেই মার্কনি নিজের নামে চালিয়ে দিলেন। বন্ধুর প্রতিও তিনি কৃতঘ্নের মতোই আচরণ করেন।১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর দুপুরে মার্কনি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে একটা ধাতব তার ৪০০ ফুট উপরের আকাশে তুললেন এবং আয়রন মার্কারি আয়রন কোহেরার উইথ টেলিফোন গ্রাহক যন্ত্রের সাহায্যে স্পষ্ট শুনতে পেলেন ইংল্যান্ড থেকে আটলান্টিক অতিক্রম করে ভেসে আসা পুনঃপুনঃ বেতার তরঙ্গ সংকেত টক্ টক্ টক্ টক্ শব্দ।
তখন বেলা সাড়ে বারোটা, টেলিফোনটা দিলেন তার সঙ্গী জর্জ স্টিফেনকে। তিনিও স্পষ্ট শুনলেন সেই শব্দ।খবরের কাগজ ও টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল মার্কনির বিজয় গৌরব। ১৯০৯ সালে মার্কনিকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হলো। আর বাঙালি বিজ্ঞানী বেতার তরঙ্গের সৃষ্টির আবিষ্কারক হিসাবে অজ্ঞাত থেকে গেলেন। তাঁর লেখা ‘অব্যক্ত’ বইয়ে এই কষ্টের কথা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘যাঁহারা আমার বিরুদ্ধ পক্ষে ছিলেন তাঁহাদেরই মধ্যে একজন আমার আবিষ্কার নিজের বলিয়া প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন ফলে বহু বৎসর যাবৎ আমার সমুদয় কার্য পন্ডপ্রায় হইয়াছিল। এ সকল স্মৃতি অতিশয় ক্লেশকর।’১০৯ বছর আগে পরাধীন দেশে অশ্বেতাঙ্গ বিজ্ঞানীর পক্ষে বেতার যন্ত্রের উদ্ভাবকের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তিনি বিশ্বকে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তা নিয়েও প্রথমে কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। অনেক লড়াইয়ের পর এই আবিষ্কারটা তার থেকে আর কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি।