ভারত মহাসাগরের বুকে বিস্ময় দ্বীপ সোকোত্রা। গাছের পাতা থেকে শুরু করে ফুল, পাখি— এই দ্বীপের সব কিছুই বিরল। পৃথিবীর আর কোনও প্রান্তে এই সমস্ত প্রাণী বা গাছগাছালি দেখা যায় না।সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ ইয়েমেনের অন্তর্গত। আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব উপকূল থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার পূর্বে অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সোকোত্রা।আরবীয় উপদ্বীপ থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে সোকোত্রাকে আফ্রিকা মহাদেশের অংশ হিসাবে ধরা হয়। গাছপালা, পশুপাখি এবং মানুষের বৈচিত্র্য দ্বীপটিকে শিরোনামে তুলে এনেছে বার বার।
ছোট ছোট একাধিক ভূখণ্ড থাকলেও সোকোত্রার মূল ভূখণ্ডেই মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। এই দ্বীপের লোকসংখ্যা মেরেকেটে ৫০ হাজার। মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ সোকোত্রায় বাস করেন।সোকোত্রাবাসীর পেশা মূলত মাছ ধরা। এ ছাড়া, মৌমাছির মধু সংগ্রহ এবং পশুপালন করে থাকেন কেউ কেউ। অনেকে আবার যুক্ত খেজুর চাষের সঙ্গে।সোকোত্রা দ্বীপে অন্তত ১৯০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদ এবং পরিবেশ বিশারদদের দাবি, এই ১৯০ প্রজাতির পাখি সোকোত্রার বাইরে আর কোথাও দেখা যায় না। এদের মধ্যে ৪৪টি প্রজাতি ওই দ্বীপেই থাকে। বাকিরা পরিযায়ী, নিয়মিত দ্বীপে উড়ে আসে তারা।সোকোত্রার জলজ জীবনও বৈচিত্র্যময়। নানা বিরল প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া, লবস্টার এই দ্বীপে পাওয়া যায়।
বিশ্বের অন্য কোথাও এদের দেখা মেলে না।সোকোত্রার বিরল প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সোকোত্রা ওয়ার্বলার পাখি, সোকোত্রা বান্টিং পাখি, সোকোত্রা লাইমস্টোন ক্র্যাব (চুনাপাথর কাঁকড়া), সোকোত্রা করমোর্যান্ট, সোকোত্রা সানবার্ড, মিশরীয় শকুন, লগারহেড টার্টল।ঘোস্ট ক্র্যাব বা ‘ভূত কাঁকড়া’ এই দ্বীপের স্থানীয় একটি প্রাণী। হালকা হলুদ রঙের এই কাঁকড়া সমুদ্রের ধারে বালির সঙ্গে প্রায় মিশে থাকে। আবার টকটকে লাল ঘোস্ট ক্র্যাবও পাওয়া যায় সোকোত্রায়।এই দ্বীপের গাছগাছালির বৈচিত্র্যও চোখে পড়ার মতো। উল্লেখযোগ্য কিছু গাছের নাম, সোকোত্রা পোমেগ্র্যানেটস, ফ্র্যাঙ্কিন্সেন্স, ঘৃতকুমারী গাছের নানা প্রজাতি, জায়ান্ট সাক্লুসেন্ট ট্রি, মীর ট্রি ইত্যাদি।সোকোত্রা দ্বীপের বিখ্যাত একটি গাছের নাম ‘ড্র্যাগন ব্লাড ট্রি’। এই গাছের ছাল থেকে লাল রঙের এক প্রকার তরল পদার্থ বেরিয়ে আসে।
এটি রেসিন বা গাছের রজন পদার্থ। এই রক্তাভ তরলের কারণেই গাছটির এমন নামকরণ করা হয়েছে। যেন ‘ড্রাগনের রক্ত’ গড়িয়ে পড়ে এই গাছের শরীর থেকে।এই গাছটি দেখতেও চমকপ্রদ। সরু লম্বা কাণ্ড উপর দিকে উঠে গিয়ে শাখাপ্রশাখা মেলে দিয়েছে ছাতার মতো। তার উপরেই গজিয়েছে সবুজ পাতা। এই গাছ থেকে প্রাপ্ত রজন ওষুধ তৈরির কাজে লাগে।সোকোত্রায় যে গাছগাছালি পাওয়া যায়, দ্বীপের বাইরে পৃথিবীর আর কোনও প্রান্তে সে সব গাছের অস্তিত্ব নেই। চেষ্টা করেও অন্য কোথাও এই সব গাছ পোঁতা বা বাড়িয়ে তোলা যায়নি। প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।বিরল প্রজাতির প্রাণী ও গাছপালার আঁতুড়ঘর হওয়ার কারণে অনেকে এই দ্বীপটিকে পৃথিবীর বাইরের কোনও ভিন্গ্রহী ক্ষেত্র বলে মনে করেন। কেউ কেউ বলেন, প্রাচীন কালে কখনও ভিন্গ্রহীরা নেমেছিল সোকোত্রায়। সেই থেকে পৃথিবীর বাকি অংশের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে দ্বীপটি।
সোকোত্রার বিচ্ছিন্নতার রহস্য অবশ্য সমাধান করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানিয়েছেন, আজ থেকে প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে, পৃথিবীর স্থলভাগ যখন মহাদেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, তখন থেকে সোকোত্রার বিচ্ছিন্নতার সূচনা।সমস্ত মহাদেশীয় ভূখণ্ড একসঙ্গে গন্ডোয়ানা নামে পরিচিত ছিল। তা থেকে কোনও ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে নীচের দিকে সরে আসে সোকোত্রা। ভারত মহাসাগরের বুকে সেই থেকে শুরু তার একার রাজত্ব।পৃথিবীর বাকি ভূখণ্ড থেকে আলাদা এবং বহু দিন পর্যন্ত তার সংস্পর্শে না থাকার কারণে এই দ্বীপের সমস্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।বৈচিত্রে ঠাসা সোকোত্রা এই কারণেই রহস্যের আঁতুড়ঘর। স্থানীয় গাছগাছালি আর প্রাণীজগৎ নিয়ে সৃষ্টির আদিকাল থেকে আপন খেয়ালে এগিয়ে চলেছে এই দ্বীপ।