হাঁটাচলা করতে অপারগ। খাওয়াদাওয়া করতে গেলেই অসুস্থবোধ করতেন। শরীর জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণায় এক মুহূর্তের বিরাম নেই। গত কয়েক বছর ধরে এ ভাবেই হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ২৩ বছরের লিলি তাই।যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেন লিলি। গত সপ্তাহে হাসপাতাল থেকেই আইনি কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন তিনি। বুধবার তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী নিষ্কৃতিমৃত্যু দেওয়া হয়েছে লিলিকে। ১০ সেকেন্ডেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তিনি।অস্ট্রেলীয় সময় অনুযায়ী বুধবার চিরবিদায় জানানো হয় লিলিকে। জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টায় তাঁকে ঘিরে সংবাদমাধ্যমের প্রস্তুতি কম ছিল না। হাসপাতালে তাঁর রোজনামচার খুঁটিনাটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বের নানা সংবাদমাধ্যম।
দক্ষিণ অ্যাডিলেডের ফ্লিন্ডার্স মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসাধীন লিলি অটো-ইমিউন অটোনমিক গ্যাগ্লিয়োনোপ্যাথি (এএজি)-র সমস্যায় ভুগছিলেন। এই সমস্যায় ধীরে ধীরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন রোগী। হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ক্রমাগত যন্ত্রণা হতে থাকে। মোদ্দা কথায়, রোগীর স্নায়ুতন্ত্রকেই আঘাত করে এটি। ব্যথা উপশমের জন্য লিলিকে অ্যাডিলেডের হাসপাতালে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে রাখা হয়েছিল। তবে তাতে অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। দিন দিন তাঁর শারীরিক অবস্থা বিগড়ে যাচ্ছিল। স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনের সিদ্ধান্ত কেন নিলেন লিলি? অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম ‘দি অ্যাডভারটাইজ়ার’-এর কাছে লিলি বলেন, ‘‘এই যন্ত্রণা এতটাই অসহ্য যে, বেঁচে থাকার কোনও অর্থ নেই। তা ছাড়া, নিজের হাতেই নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিলাম।’’
জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টায় নিজের কয়েকটি সাধপূরণ করতে চেয়েছিলেন লিলি। তার মধ্যে ছিল সমুদ্রতটে ঘোরা। লিলির সে সাধপূরণে বাধা হননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।হাসপাতালের বিছানায় শুইয়েই লিলিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সমুদ্রের ধারে। বিছানায় শুয়েই সমুদ্রের অগুনতি ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়েছিলেন লিলি। নরম পানীয়ের স্বাদও নিয়েছিলেন। সে ছবিও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে ছাপা হয়।ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘ডেলি মেল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, লিলির দেহে সমস্যার শুরু কিশোরী অবস্থায়। ১৭ বছর বয়সে ইলার্স ড্যানলোস সিনড্রোম (ইডিএস) উপসর্গ ধরা পড়েছিল তাঁর। তাতে ত্বক অতিরিক্ত নমনীয় হওয়া থেকে অস্থিসংযোগগুলি অতিরিক্ত মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। রক্তনালিতেও সমস্যা দেখা দেয়।ইডিএস ধরা পড়ার বছরখানেক পর লিলির শ্বাসযন্ত্রের একাংশে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। এমনকি, প্রাকৃতিক ভাবে মলত্যাগও করতে পারতেন না তিনি।
ওই সময় থেকে খাবার খেলে অথবা কোনও পানীয়ে চুমুক দিলেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন লিলি। তত দিনে তাঁর মেরুদণ্ডের ভিতর থেকে তরল পদার্থ বার হয়ে যেতে শুরু করেছে। এর জেরে তাঁর হাঁটাচলা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সে জন্য চিকিৎসা শুরু হলেও লিলির শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।ইডিএসের চিকিৎসার জন্য অ্যাডিলেড থেকে সিডনি পাড়ি দিয়েছিলেন লিলি। সেখানকার ম্যাকোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে বিশেষজ্ঞদের একটি দল তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। এক শল্যচিকিৎসকের কাছেও গিয়েছিলেন তিনি।সিডনিতে গিয়ে সাময়িক ভাবে কিছুটা সুরাহা হলেও আখেরে তা কাজে আসেনি। সে সময় থেকে মাথার চারপাশে একটি রিঙের মতো ‘ব্রেস’ পরে থাকতে হত লিলিকে। মেরুদণ্ডের সামান্য অবস্থান পরিবর্তন হলেই যাতে তাঁর মাথা বা ঘাড়ের নড়াচড়া বন্ধ করতে পারে ওই ‘ব্রেসটি’।‘ব্রেস’ পরা ছাড়া খাওয়ার জন্য লিলির নাক দিয়ে একটি টিউব ঢোকানো হয়েছিল। সে সময় তাঁর ওজন ছিল ৪০ কেজি ছুঁইছুঁই।খাবার হজম করানোর জন্য লিলির মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার করে একটি টিউব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাতে ওই টিউবের মাধ্যমে তার পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ করানো যায়। অতিমারি পর্বে ওই অস্ত্রোপচারের সময় থেকেই লিলির সঙ্গে বাইরের লোকজনের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
অস্ত্রোপচারের পর সিডনিতে নিউরো ইমিউনো লজিস্টের চিকিৎসা শুরু হয়। সে সময় ধরা পড়ে, লিলি এএজি-তে আক্রান্ত। এর জেরে ভবিষ্যতে তাঁর একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা।পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আরও ধরা পড়ে, লিলির মস্তিষ্কের বাঁ দিকে একটি বড়সড় ক্ষত রয়েছে। সিডনি থেকে অ্যাডিলেডে ফিরিয়ে আনা হয় লিলিকে। সেখানে ফ্লিন্ডার্স মেডিক্যাল সেন্টারের লরেল হসপিসেস-এ ভর্তি করানো হয়েছিল তাঁকে। ওই সময় থেকেই বেঁচে থাকার দিন গোনা শুরু লিলির।সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই যে এক দিন তাঁকে চলে যেতে হবে এবং তা যে কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা, এ ভাবনা মনে চেপে বসেছিল লিলির। যন্ত্রণা এড়াতে হাসপাতাল বিছানায় বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটাতে শুরু করেছিলেন তিনি।হাসপাতালে থাকাকালীন অ্যানালিস হল্যান্ডের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল লিলি। ২৩ বছরের অ্যানালিসও এএজি-তে আক্রান্ত। জীবনের শেষ দিনে অ্যানালিসের সঙ্গ কিছুটা স্বস্তি দিলেও লিলির পরিবারের কাছে তা যথেষ্ট নয়। লিলি বলেন, ‘‘হাসপাতালের ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন মা। তাঁর কাছে এই (স্বেচ্ছামৃত্যুর) সিদ্ধান্ত অসহনীয়। তবে আমাকে কষ্ট পেতে দেখার চেয়ে এ সিদ্ধান্তই ঠিক।’’‘ডেলি মেল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৮ জন নাগরিককে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। তবে মৃত্যুর আগে যে কোনও মুহূর্তে নিজেদের সেই সিদ্ধান্ত বদল করতে পারেন তাঁরা।