বিক্রম সারাভাইয়ের জন্য কেমব্রিজে সুপারিশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘আপনাদের জন্য ইনি সুযোগ্য!’

চাঁদের পিঠে চন্দ্রযানকে নিরাপদে অবতরণ করানোর মূল কান্ডারি ছিল, ‘বিক্রম’। এই ল্যান্ডারে চেপেই সফল চন্দ্রাভিযান। ইসরো আগেই জানিয়েছিল, ল্যান্ডারের নাম ‘বিক্রম’ রাখা হয়েছিল কেন। এমনকী আগের চন্দ্রযান ২ অভিযানের ক্ষেত্রেও ল্যান্ডারের নাম ছিল এই ‘বিক্রম’ই। ডঃ বিক্রম আম্বালাল সারাভাই (Doctor Vikram Ambalal Sarabhai)। ইসরোর প্রাণপুরুষ। তাঁকে সম্মান জানিয়েই এই ঐতিহাসিক চন্দ্রযাত্রায় তাই ‘বিক্রম’ নামটা যোগ করেছে ইসরো। ল্যান্ডার তৈরি হয়েছে প্রয়াত বিক্রম সারাভাইয়ের নামেই।কিন্তু জানেন কি, সারাভাইয়ের এই এত বড় মহাকাশ বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পিছনে অবদান ছিল এক মহান বাঙালিরও! তিনি আর কেউ নন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তাঁর লেখা একটি চিঠিই কিন্তু সারাভাইকে পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্বের আঙিনায়। আজ ইসরোর চরম সাফল্যের দিনে যখন বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের কথা বারবার ফিরে আসছে, তখন আরও বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে রবি ঠাকুরের সেই চিঠিও।জানা গেছে, গুজরাত কলেজ থেকে বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হয়ে সারাভাই যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করতে যাচ্ছিলেন, তখন সেখানে তাঁর জন্য একটি ‘রেকমেন্ডেশন লেটার’ লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে চিঠির ছবি আজ ফের ঘুরেফিরে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। রবি ঠাকুর লিখেছেন, ‘আমি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মিস্টার বিক্রম সারাভাই অ্যাডমিশনের জন্য কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করছি। এই তরুণের বিজ্ঞান সাধনার প্রতি অসীম আগ্রহ, কেমব্রিজে শিক্ষালাভের সুযোগ পেলে তা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

```

আমি ব্যক্তিগতভাবে এঁকে চিনি, এঁর পরিবারের সুশিক্ষা সম্পর্কেও জানি। ওঁর ভাই-বোনেরা এখন অক্সফোর্ডে পড়ছে। আমার বিশ্বাস, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশনের জন্য ইনি সুযোগ্য।’১৯১৯ সালের ১২ অগস্ট আমদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন আম্বালাল সারাভাইয়ের ছেলে বিক্রম সারাভাই। তিনি ছিলেন আম্বালাল ও সরলা দেবীর আট সন্তানের একজন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন আমদাবাদ ভ্রমণে এসেছিলেন, তিনি আম্বালাল সারাভাইয়ের বাড়িতে অতিথি হিসেবে থেকেছিলেন। তিনি তখনই ছোট্ট বিক্রম সারাভাইকে দেখেই বলেছিলেন, ‘এই ছেলে বড় হয়ে বিরাট বড়ো কিছু করবে।’সত‍্যিই তাই হয়। সেই ছেলেই বড় হয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিদ হয়। তাঁকেই ভারতের ‘অন্তরীক্ষ গবেষণার জনক’ বলা হয় পরবর্তী কালে। ১৮ বছর বয়সে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে অঙ্ক এবং পদার্থবিদ্যা পড়তে যান তিনি। রবি ঠাকুরের সুপারিশপত্রটি সেই সময়েরই। সেখান থেকে ডক্টরেট করেন তিনি। ‘কসমিক রে ইনভেস্টিগেশন ইন ট্রপিকাল ল্যাটিচিউড’ বিষয়ে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি।

তবে এর পরে বিদেশে লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি ১৯৪৭ সালে ভারতে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি বিখ্যাত ভারতীয় নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ডঃ সিভি রমনের পরামর্শে ইন্ডিয়ান ইনস্টিউট অফ সায়েন্স, ব্যাঙ্গালোরে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যান। এর পরেই উদ্যোগী হন গবেষণা কেন্দ্র তৈরির কাজে। পরিবার ও বন্ধুদের সাহায্যেই ১৯৪৭ সালের ১১ নভেম্বর আমদাবাদে গড়ে তোলেন ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ (পিআরএল)। এর পরে ১৯৬২ সালে তিনি ভারতে মহাকাশ গবেষণার জন্য তৈরি করেন ‘ভারতীয় জাতীয় কমিটি’। পরে এই প্রতিষ্ঠানেরই নাম হয় ‘ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র’ বা ইসরো (ISRO)। ওই বছরেই বিক্রম সারাভাই দক্ষিণ ভারতের থুম্বায় ‘থুম্বা ইকোয়টোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীতে যার নাম হয় ‘বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার’। ভারতের পারমাণবিক গবেষণার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টস প্রতিষ্ঠাতেও তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। পারমাণবিক গবেষণাকে তিনি শিক্ষা এবং দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।

```

পরবর্তীকালে অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন তিনি। পিআরএল ছাড়াও আমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, কমিউনিটি সায়েন্স সেন্টার, দর্পণ অ্যাকাডেমি-সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মান দেওয়া হয়। সারাভাই দেশের রকেট প্রযুক্তির নেতৃত্বেও ছিলেন। তিনি ভারতে স্যাটেলাইট টিভি সম্প্রচারের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।এর পরে ১৯৭১ সালে কেরলের কোভালামে রহস্যজনক ভাবে তার মৃত্যু হয়। ১৯৭২ সালে মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ সম্মানেও ভূষিত করা হয় তাঁকে। এর পরেও ১৯৭৩ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’-এর সিন্ধান্ত অনুযায়ী চাঁদের একটি গহ্বরের নাম রাখা হয় ‘সারাভাই ক্রেটার’। তাঁরই দূরদর্শিতা, গবেষণা এবং প্রচেষ্টার ফলে ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’কে ১৯৭৫ সালে মহাকাশে কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছিল।

আজ, মৃত্যুর পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে, এখনও মহাকাশ বিজ্ঞানে উজ্জ্বল হয়ে আছে নামটি। ‘বিক্রম’ ল্যান্ডার ছাড়া সফল হতো না চন্দ্রযান ৩ অভিযান। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছনো প্রথম দেশ হিসেবে ভারত যে জয়পতাকা ওড়াল বিশ্বের দরবারে, সে পতাকায় মিশে আছেন বিক্রম সারাভাই। আর তাঁর কৃতিত্বেই জড়িয়ে আছে আমাদের রবি ঠাকুরের নামটিও!