জন্ম দেওয়ার পর ছেলের দুটি হাত নেই দেখে জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন মা। প্রতিবেশী-আত্মীয়দের একাংশ তখন পরামর্শ দিয়েছিল, দু’হাত না-থাকা ছেলেকে শৈশবেই প্রাণে মেরে দিতে । কিন্তু, মা-বাবা-সহ পরিবারের কেউ সেই যুক্তি মেনে নেননি। উলটে তাঁরা সবাই মিলে দু’হাত না-থাকা ছেলেকেই পরম স্নেহে লালন পালন করেন। বড় করে তোলেন। আজ সেই ছেলে ৩৭ বছরের সুজিত দাঁ দুই পা দিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে নিজেই নিজের অন্নের সংস্থান করছেন। যার দৌলতে আইটিআই পাস ছেলেটি প্রতিবন্ধী যুবক-যুবতীদের কাছে হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা।
এই যে বিরাট সাফল্য। এই যে আইকন হয়ে ওঠা, এটা কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু মানুষ ছাড়া এতদিন সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কারণ, সুজিত কোনও শহর বা শহরতলি কিংবা মফস্বল শহরেরও বাসিন্দা না। থাকে, পূর্ব বর্ধমানের রায়না বিধানসভার প্রত্যন্ত গ্রাম উচালনে। যৌথ পরিবারের ছেলে। জীবন তাঁকে বারেবারে আঘাত করেছে। জন্মের সময়ই দুই হাতের অভাব তাকে ভুগিয়েছে। তাতেও যেন অনেকটা যন্ত্রণা পাওয়া বাকি ছিল। ছোট বয়সেই মারা যান বাবা স্বপন দাঁ।বাড়িতে বিধবা মা পুতুলদেবী-সহ পরিবারের অন্যরা অবশ্য এই পরিস্থিতিতে সুজিতের সহায়-সম্বল হয়ে ওঠেন। শিশু বয়স থেকেই সুজিতকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগান তাঁরা। আর, যিনি এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন, তিনি হলেন গ্রামের মাস্টার মশাই শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য। পায়ে পেনসিল গুঁজে দিয়ে হাতে করে পা ধরে ওই মাস্টার মশাই তাঁকে লিখতে শিখিয়েছেন। আর, সেই মাস্টার মশাইয়ের…
অনুপ্রেরণাতেই সুজিত টপকেছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকী আইটিআইয়ের সার্ভে কোর্সের গন্ডি। আইটিআই পাশের পর ডিভিসির চাকরির পরীক্ষায় বসেছিলেন। প্যানেলে নাম ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদলের পর সব যেন কী হয়ে যায়! তার পর সেই চাকরির ব্যাপারে আর কিছুই তিনি জানতে পারেননি। ডিভিসিও আচমকা নিয়োগের ব্যাপারে চুপ হয়ে যায়।সুজিতও কিন্তু বসে থাকেননি। এক পরিচিত চালকের সাহায্যে দুই পা দিয়েই ট্রাক্টর চালানো শিখে নিয়েছেন। তারপর ট্রাক্টর চালিয়েই শুরু করেছেন উপার্জন করা। এখন ট্র্যাক্টর চালানোর পাশাপাশি ধানের ব্যবসাও করেন। সম্প্রতি খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসাও শুরু করেছেন। কিন্তু, দোকানে ব্যবসার খাতায় হিসেব রাখা, খরিদ্দারকে মালপত্র দেওয়া, এসব কাজ করেন কীভাবে? উত্তরে সুজিত জানান, এই সবকিছুই তিনি পা দিয়েই করেন। শুধু তাই না, অ্যান্ড্রয়েড ফোন পায়ে ধরে নিয়েই তিনি অন্যের সঙ্গে কথা বলেন।
এমনকী, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুকও পা দিয়েই করেন। খাওয়া-দাওয়া করতে সমস্যা হয় না? সেই ব্যাপারেও সুজিত স্বয়ংসম্পূর্ণ। জানালেন, ‘বাড়িতে থাকলে মা খাইয়ে দেন। আর বাইরে থাকলে পায়ের আঙুল দিয়ে চামচে করে খাবার তুলে খান।’প্রতিবন্ধী এই যুবকের দাবি, পা দিয়ে তাঁকে সবকিছু করতে হয় বলে কোনও আক্ষেপ নেই। বরং, তিনি এজন্য নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। কারণ হাত না-থাকলেও শুধুমাত্র যে দু’পা দিয়েও জগতে সব কিছুকে জিতে নেওয়া যায়, তা তিনি করে দেখাতে পেরেছেন। তাঁর শুধু একটাই আক্ষেপ, সরকার বা প্রশাসন কেউ পাশে দাঁড়ালো না। কোথাও একটা স্থায়ী চাকরি পেলে তাঁর অনেক উপকার হত। যে ছেলেকে জন্মের পরই অনেকে মেরে ফেলতে বলেছিল, সেই ছেলেই আজ মানুষের মত মানুষ হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে তাই গর্বের শেষ নেই সুজিতের মা পুতুল দাঁ-এর। বললেন, ‘নিজের চেষ্টায় আর ঈশ্বরের কৃপায় আজ আমার ছেলে শুধু নিজেই সাবলম্বী হয়নি। অন্য প্রতিবন্ধীদেরকেও জীবনের দিশা দেখাচ্ছে।’
ভাইপোর জন্য গর্বিত সুজিতের ছোটকাকা তুলসী দাঁ-ও। তিনি বললেন, ‘সাধারণ মানুষ দুই হাতে যা যা করে, তার ৯০ শতাংশ কাজ সুজিত শুধু পা দিয়েই করতে পারে।’ রাজ্যের পঞ্চায়েত-গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার রায়না বিধানসভারই ভূমিপুত্র। উচালনের কাছেই কামারহাটি গ্রামে প্রদীপবাবুর বাড়ি। সুজিত দাঁ-এর জীবন সংগ্রামের কাহিনি শুনে মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গিয়েছেন। প্রতিবন্ধী এই যুবকের লড়াইকে কুর্নিশ জানানোই শুধু নয়। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী।